Bengali Poems

Read Bengali poems & short stories by Rina Ghosh. Please feel free to comment on the posts.

মিনির কথা


“দিদিমণি ! আমার হয়ে গেছে । দেখবে এখন ?”
হোমওয়ার্কের খাতাটা উঠিয়ে মিনি আমার দৃষ্টি  আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ।
“দাও, দেখি ।” আমি হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিই । পাঁচটা বাক্যরচনা করতে দিয়েছিলাম । দৃষ্টি ফেলতেই চোখ কপালে উঠলো । “একি !” সে লিখেছে-
গমগম্- পায়রা গমগম ভক্ষন করে  ।
গোধূলি- ধুলোর ওপর দিয়া  গরু হাঁটিয়া যাইলে গোধূলির উৎপত্তি হয় ।
চরাচর- কড়া রোদে বাহির হইলে গা চরাচর করিয়া ফাটিতে থাকে ।
হর্ষ- হর্ষবর্ধনকে তাহার মাতা আদর করিয়া ডাকিত হর্ষ ।
দম্পতি- এক দম্পতি দুঃখের কথা ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ মরিয়া গেল ।
এই হল আমার ছাত্রী মিনি ওরফে রাজশ্রী মল্লিক , ক্লাস সিক্সে পড়ে ,বয়স সাড়ে এগারো । আমি ওর গৃহশিক্ষিকা , ঘরে গিয়ে পড়াই । এই অভূতপূর্ব বাক্যরচনা দেখে চোখ কপালে উঠলেও চমকালাম না । কারণ মিনির মস্তিষ্কের জ্ঞানসম্ভার সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহল , সঙ্গে ওর পারিবারিক পরিবেশ সম্বন্ধেও ।
       আমাদের পাড়াতেই ওরা থাকে, ওর বাবা ৫বছর মানসিক হাসপাতালে কাটানোর পর সিধে ওখান থেকে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসে , যথারীতি মেয়েপক্ষের অজান্তে । মিনির দাদুর ধারণা ছিল বিয়ে হয়ে গেলেই ছেলে সুস্থ হয়ে উঠবে !
       মিনির দুই পিসি । বরপিসি বাপের বাড়িতেই থাকে, বিবাহিতা, একটি ছেলে,সে তার বাবার সঙ্গে থাকে । এই ছেলে হবার একমাসের মধ্যে শ্বশুরবাড়ির লোক তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় ।পিসির শাশুড়ি একদিন দেখে ফেলেন বউমা একমাসের বাচ্চাটিকে নিয়ে ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখতে যাচ্ছেন । পরম আশ্চর্য হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করাতে পিসি অবলীলায় উত্তর দেন , “ বড্ড গরম পড়েছে কিনা,তাই ঠাণ্ডা হতে দিচ্ছি ।”
        তখন উনারা বুঝতে পারেন পিসির আগের দুটি বাচ্চা ঠিক এই বয়সেই কি করে প্রচণ্ড নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যায় ! সেইদিনই  বড়পিসিকে বাপের বাড়ী ফেরৎ পাঠিয়ে দেন তাঁরা ।
         ছোট পিসির আর এক কাহিনী ! তিনি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যখন তখন ওপর তলার ঘর থেকে যা হাতের কাছে পেতেন তাই নীচে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতেন আর খিলখিল করে হেসে হাততালি দিয়ে নাচতেন ! তিনি ভাগ্যবতী ! উনার স্বামী অনেক টাকাপয়সা খরচা করে উনার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন , বাপের বাড়ী আর পাঠাননি ।
       মিনির বাবা দশ আঙ্গুলে দশটি আংটি পরে ঘোরেন । এমনিতে চুপচাপ থাকেন , কিন্তু হঠাৎ করে যখন মাথা বিগড়োয় তখন শুরু হয় তাঁর  আজগুবি সব ব্যাবহার – জামাকাপড় পরে কলতলায় গিয়ে ধপাস করে বসে নল চালিয়ে সেই দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকবেন, নয়তো নিজে নানারকম গালিগালাজ করে সেটা টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে সেগুলো বাজিয়ে শুনবেন আবার কখনো বা সারা বারান্দায় ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলবেন !
      মল্লিক বাড়ির পাগলামির প্রভাব মিনির মায়ের ওপরও পড়েছিল । একদিন পড়াতে গেছি দেখি তিনি সুটকেস আর দুই ছেলে মেয়েকে বগলদাবা করে রিক্সায় উঠছেন । কি ব্যাপার,না সিনেমা দেখতে যাওয়া নিয়ে বরের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন ,তিনি আর এ বাড়ীতে থাকবেনা ,তাই বোম্বে  যাচ্ছেন ।
“বোম্বে ? এতদূরে ? কে আছে ওখানে ?”
“একজন খুব চেনা ফিলিম আর্টিস্ট আছে গো আমার ওখানে ।”
“তাই ? কে সে ?”
“ধরমেন্দ্র !”
“এ্যাঁ ! বলেন কি ?”
“বিশ্বাস হচ্ছেনা ? এই দ্যাখো ।”
একটা রঙ্গিন পোস্ট কার্ড বের করে দেখাল মিনির মা । দেখি ধরমেন্দ্রর ছবির ওপর “To Ruma,with love” কালো কালি দিয়ে লেখা । রুমা মিনির মায়ের নাম ।
তিনি গর্ব সহকারে আমায় জানালেন একবার উনি উনার প্রিয় হিন্দি সিনেমার নায়ক ধরমেন্দ্রকে একটি  চিঠি লিখেছিলেন আর তার উত্তরে তিনি এই পোস্ট কার্ডটি পাঠিয়েছেন । কত ভাল মানুষ এই ধরমেন্দ্র ! মিনির মায়ের নাম লিখে সই করে নিজের ছবি পাঠিয়েছেন , সশরীরে গিয়ে দেখা করলে নিশ্চয়ই তিনি মিনির মাকে সিনেমার শুটিং দেখাতে নিয়ে যাবেন ! তাই তাঁর কাছেই উনি যাচ্ছেন ।
“কিন্তু ঠিকানা ? ঠিকানা জানেন ?”
“জানার কি আছে ? অত বড় স্টার ! বোম্বের সবাই চেনে । ষ্টেশনে নেমে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই হবে !”
গটগট করে অহঙ্কারে পা ফেলে রিক্সায় গ্যাঁট হয়ে বসে তিনি চলে গেলেন ।
          এর ঠিক ৫/৬ দিন পর মিনি ভাইকে নিয়ে এসে হাজির আমার বাড়ি ।
“দিদিমণি ! বোম্বে থেকে তোমার জন্য এইটা এনেছি ।” একটা পেন্সিল !
“ও তাই ! বাঃ ! থ্যাঙ্ক ইয়ু ! তা এত তাড়াতাড়ি ফিরলে ? ধরমেন্দ্র মামা তোমাদের আসতে দিল ?”
“আর বোলনা দিদিমনি , ধরমেন্দ্র মামার বাড়িতে তো ঢুকতেই দিলনা ! বলে উনি নেই । মা যত পোস্ট কার্ড টা দেখিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে যে উনি এটা মাকে পাঠিয়েছেন ওরা তত ক্ষেপে যায় । কিছুতেই আমাদের কথা শোনেনা , কিরকম অসভ্য দারোয়ানগুলো জানো , লাঠি নিয়ে পর্যন্ত তাড়া করেছিল ! ”
“সেকি ! তারপর ?”
“তারপর অটো ড্রাইভার আমাদের দারা সিঙের বাড়ি নিয়ে যায় ।”
“দারা সিং ? উনি কেন ?”
“মা বলল দারা সিং হনুমানের পার্ট করেন তাই উনিও খুব ভাল মানুষ হবেন । তা ওখানে আমরা অনেকক্ষণ বসার পরেও দেখা হলনা । ওরা বলল উনি নাকি দিল্লি গেছেন,ফিরতে দেরি হবে ।”
“তারপর ?”
“তারপর আমরা হোটেলে থাকতে গেলাম,সেখানে তো অনেক টাকা চাইল, আমরা তো অত নিয়ে যাইনি ,ভেবেছিলাম ধরমেন্দ্র মামার বাড়ী থাকব । তা তো আর হলনা, তাই সেই রাতটা ষ্টেশনে কাটালাম । সকালে ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরে এসেছি ।”
“আর এই পেনসিলটা ?”
“বোম্বে ষ্টেশন থেকে । ভাল না দিদিমনি ?”
“খুব ভাল । খুব সুন্দর ।”
এই হল মিনির পরিবারের পরিচয় । তাই এইরকম আজব বাক্যরচনার কলাকৌশল যে একমাত্র তার উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই বেরোতে পারে সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিলনা । কিন্তু তার ওপর রাগ করতে পারিনা, তাকে বকতে পারিনা । কোথায় যেন কি একটা আমায় বাধা দেয় !  কয়েকদিন আগের  একটা ঘটনা বলি ।
     সেদিন বিকেলে গেছি যথারীতি পড়াতে । মিনি একটা খাতা নিয়ে এল চোখ মুছতে মুছতে ,“দ্যাখো না দিদিমনি ! কত সুন্দর একটা রচনা লিখেছিলাম ! স্কুলের দিদিমনি পুরোটা ঘ্যাঁচ করে কেটে দিয়েছে ! ১ নম্বরও দেয়নি !”
“কই দেখি ।”
লিখতে দেওয়া হয়েছে ‘বর্ণপরিচয়ের রচয়িতা সম্বন্ধে ১৫০ টি শব্দের মধ্যে কিছু লেখো ।”
লাল কালির জাল থেকে মিনির লেখাটা উদ্ধার করে পড়তে শুরু করলাম-
“বর্ণপরিচয়ের রচয়িতা খুব ভালমানুষ ছিলেন । তিনি বর্ণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । বর্ণ অনেক প্রকার হয়, গৌরবর্ণ , শ্যামবর্ণ , উচ্চবর্ণ , নিম্নবর্ণ ইত্যাদি । লেখক আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন এইরকম বর্ণ ভেদাভেদ করতে নেই । তিনি খুব ধনী পরিবারের লোক ছিলেন কিন্তু দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে সব কিছু দিয়ে গরীব হয়ে গিয়েছিলেন । তার চুল ঘন কোঁকড়া ছিল কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়াতে সামনের দিকে একটু টাক পরে যায় । তিনি চোখে চশমা পড়তেন,খাদির ধুতি পাঞ্জাবী ছিল তাঁর পছন্দের পোশাক । পায়ে তাঁর সবসময় থাকত রবারের চটি । তিনি বাচ্চাদের খুব ভালবাসতেন । তাঁর অনেক গুণ ছিল, সে সব লিখতে গেলে ১৫০ শব্দের থেকে বেশি হয়ে যাবে বলে আর লেখা গেলনা । দেশের জন্য উনি অনেক কিছু করেছিলেন, তাঁকে আজ  আমরা স্যালুট জানাই,জয় হিন্দ !”   
এবার হাসব কি কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না , গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছিল না, কোনরকমে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-
“বিদ্যাসাগর এইরকম ছিলেন ?”
বড় বড় চোখ করে মিনি বলে উঠল , “বিদ্যাসাগর ? সে আবার কে ?”
“এই যে বর্ণমালার রচয়িতা, কেন তুমি জাননা ? ”
“ওমা তাই নাকি ?  সে তো আমি জানিনা ! রচয়িতা মানে আমি তো ভেবেছি যে রচনা লেখে !”
“তাহলে চেহারার বর্ণনা কি করে দিলে ?”
একগাল হেসে মিনির জবাব, “এটা তো খুবই সোজা, সব মহান মানুষেরা তো এইরকমই হয় ! তাঁদের চোখে চশমা থাকে, খাদির পোশাক,রবারের চটি পরে , বাচ্ছাদের ভালোবাসে ,দেশের জন্য অনেক কিছু করে ।”
ওর এই অগাধ জ্ঞানের কাছে আমি ধরাশায়ী ! মিনমিন করে বললাম, “আর কোঁকড়া চুল ? এটা কোথা থেকে জানলে ?”
গালে হাত রেখে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মিনি বলল, “হায় দিদিমণি  এটাও জাননা ? বাঙ্গালিদের চুল তো কোঁকড়াই হয় ! আর বয়স হয়ে গেলে মাথায় টাক পড়ে যায়না ? দ্যাখোনি  কি আমার দাদুকে ?”
আমার ঘাড় আপনা হতেই হিলে গিয়ে সন্মতি জানাল । মরীয়া হয়ে শেষ প্রশ্ন করি, “আর এই শেষের লাইনে স্যালুট , জয় হিন্দ এসব কেন ?”
 মিচকি একটা হাসি হেসে মিনি বলল , “ওটা একটু ডোজ দিয়েছি, যাতে লেখাটা বেশ দমদার হয় !”  
তারপরই চোখ জলে ছলছল , “এত কষ্ট করলাম তাও দ্যাখো মিস কেটে দিল ! তুমি হলে কি কাটতে বল ? কাটতে না, না ?”
আমতা আমতা করে বলতে গেলাম, “ইয়ে মানে....... 
কথা শেষ না করতে দিয়েই ঝাঁপিয়ে এসে মিনি আমাকে জড়িয়ে ধরল , হাতের  পিঠ দিয়ে নিজের চোখের জল মুছে বলল , “সেইজন্য তোমাকে এত ভালবাসি ! তুমি আমার বেস্ট দিদিমনি !”
আমার সব জড়তা কেটে গেল একটা নির্মল সরলতার ছোঁয়ায় । পরম মমমতায় ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরলাম ।  এত ভালবাসা আমি রাখি কোথায় ?

0 comments:

Post a Comment