১৯শে আগস্ট
আজ ফয়সালা হয়েই গেল । শেষ পর্যন্ত্য রমেণ মিত্র কে আমারই ফোন করতে হল ।
কাল বিকেলে যখন শিরিণের সঙ্গে কথা হল ও বলল ওর
মাসী বলছে যে মাসি বা আমি কেউ যদি রমেন মিত্রর সঙ্গে কথা বলতে যাই তাহলে ভদ্রলোক
মুখ খুলে পরিষ্কার করে কিছু বলবেন না । তার চেয়ে শিরিণ বরং একটা মেসেজ করুক , যদি
উত্তর দেন তাহলে বোঝা যাবে কথা বলতে উনি ইচ্ছুক , তাহলে শিরিণ উনাকে ফোন করে
জিজ্ঞাসা করে নিতে পারে ।
কিন্তু
শিরিণের ঠিক মন মানছিল না ।ফোন করে এভাবে বলতে ওর অস্বস্তি হচ্ছিল । আমি
বোঝালাম, “এইভাবে কতদিন আর অপেক্ষা করবি , একটা মেসেজ করেই দেখনা, যদি রিপ্লাই না
করে তাহলে তো বুঝেই যাবো যে উনি আর ইন্টারেস্টেড নন , তাহলে আর কথা বলার প্রয়োজন
হবেনা” ।
“এই রিজেকশন টাতেই যে ভয় পাচ্ছি রে লিপিকা !” খুব আস্তে করে বলল শিরিণ ।
আমি আবার সাহস যোগাতে বসলাম ।
যাই হোক এভাবে এক ঘণ্টা আলোচনা করার পর অবশেষে ও রাজী হল, বলল রাত ৯টার পর করবে ।
আমি তো ভাবলাম যাক আজই সব জানা
যাবে ।
কিন্তু
ও হরি ! রাত সোয়া বারোটায় আমায় একটা মেসেজ পাঠাল, “আমি ঠিক করেছি আমি ১৫ই আগস্ট
অবধি অপেক্ষা করব । আমি লিখলাম , “কর পোড়ারমুখী” ! তারপর কানে বালিশ চাপা দিয়ে
শুয়ে পড়লাম ।
আজ সকালে আবার ফোন !
“কি
করব বল, তোকে ফোন না করে থাকতেও পারছিনা” কাঁচুমাচু শিরিনের গলা, রাগ আর ধরে রাখতে
পারলাম না, যথারীতি আবার সেই একই কথা আলোচনা !
ও বলল, “ আগের যে দুজন দেখা করতে এসেছিল তাদের ওপর এত আকর্ষণ বোধ করিনি
,বাড়ি এসেই বুঝে গেছিলাম এদের সঙ্গে ব্যাপারটা আর এগোবে না ।কিন্তু রমেন মিত্র
যেভাবে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে, বাড়িতে এসে যেভাবে অন্তরঙ্গতা
দেখিয়েছে, তার ওপর ৫ দিনের দিন আবার ফোন
করে আপনি কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করেছে তাতে একটা টান অনুভব করেছি । তাছাড়া ভদ্রলোকের রাশভারী
স্বভাব, আদব কায়দা, কথাবার্তা একেবারে আমার বাবার মতন । তাই কেমন যেন একটা
ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেছে” ।
কথাটা
সত্যি মিথ্যে নয় , কেন যে উনি দ্বিতীয়বার ফোন করতে গেলেন ! একটা এক্সপেকটেশন তো
অটোম্যাটিকেলি তৈরি হয়ে যায় ।
আমি আবার
বললাম, “দ্যাখ, আমি কি কথা বলব ?” শিরিণ রাজী হলনা , বলল, “তুই ত প্রথম থেকে কথা
বলিসনি তাই তোকে কিছু নাও বলতে পারে , মাসি তাই বলছে” ।
আমি চুপ করে গেলাম, বুঝলাম মাসির কথাটাকেই মানতে চাইছে, থাক তবে ।
শেষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আজ রাত্রে শিরিণ নিজেই একটা মেসেজ পাঠিয়ে
জিজ্ঞাসা করবে, আপনি কি ফ্রী আছেন ? যদি উত্তরে হ্যাঁ লেখেন তাহলে শিরিণ ফোন করবে
এবং ধীরে ধীরে সাধারণ কথাবার্তা থেকে শুরু করে আসল প্রশ্নে চলে যাবে, “ আপনি কি পজিটিভ কিছু ভেবেছেন ?”
শিরিণ ফোন ছাড়ল প্রায় সোয়া একটায় ।
ভাগ্যিস প্রণয় ব্যাঙ্কের কাজে বেরিয়েছে,
কোনরকমে রান্নাটা সারলাম । স্নান করতে যাবার আগেই আবার ফোন । ভাবলাম আবার
শিরিণ বুঝি ! মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখি, না ওরনিলা । আজ বিকেলে ওর বাড়ি যাবার কথা ছিল । তা ও বলল সাজিদ আজ তাড়াতাড়ি
ঘরে চলে এসেছে, অফিসের কিছু কাজ আছে ঘরে বসে করবে । তাই ও আমার ঘরেই চলে আসবে ।
বললাম “ভালই তো,চলে আয়” । ফোন রেখে
ভাবলাম, যাহ্ ! ঠিক করেছিলাম ওদের বাড়ি যাবার পথে পেস্ট্রি আর পনীর জলেবী নিয়ে
যাবো , আমার জন্মদিনের খাওয়ানটা বাকি ছিল আজ হয়ে যেতো । কিন্তু ও নিজেই এখানে আসছে
। আর সময় ও নেই যে কিনে আনব । যাক, পরে দেখা যাবে ।
প্রায় চারটে নাগাদ ওরনিলা এল । কেরালা থেকে এবার কাঁচা পেঁপে, মোচা , সজনে
পাতা আর ওখানকার স্পেসাল সেই বড় বড় পাকা কলাও এনেছে । ওদের নিজেদের বাগানের । যখনই
কেরালা যায় আমার জন্য এইসব নিয়ে আসে ।
খুব কাশি হয়েছে ওরনিলার , বড্ড
ভোগে মেয়েটা । অনেক্ষন গল্প করলাম দুজনে ।
আরও কিছুক্ষণ বসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সাজিদ ঘরে আছে বলে উঠতে বাধ্য হল । ওকে বিদায়
দিয়ে একটু বিছানায় গড়িয়ে নেব বলে সেই যে শুয়েছি ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল, যখন চোখ খুলল
দেখি সাড়ে ছটা বেজে গেছে । আর আজকে হাঁটতে যাওয়া হলনা ।
রাত্রে আবার শিরিণের ফোন । “
দ্যাখ , কিছু মনে করিস না , স্নেহা কে ফোন করেছিলাম, ও বলছে আমাকে ফোন না করতে ।
এতে নিজেকে খেলো করা হয় । মাসিকে দিয়ে ফোন করাতে বলছে” ।
আমি বললাম, “ কিন্তু তোর মাসিই তো বলছে মাসি ফোন করলে রমেন মিত্র তেমন কিছু জানাবেনা” !
শিরিণ বলল, “ আমি মাসিকে বলছি
উনাকে ফোন করতে”। আমি বল্ললাম, “বেশ তো বল । তাহলে তো ভালই হয়” ।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে আবার ফোন ! শিরিণের গলা
ভারী, “ মাসি বলছে আমি করবনা, তুই যখন মেজদিকে দিয়ে এর আগের ফোন টা করিয়েছিলি ,
ওকে দিয়েই করা । আর নয়তো নিজে কর । লিপিকা এবার আমি কি করব ? আমার নিজের বাড়ির
লোকেরাই এরকম করছে” শিরিণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ।
আমি বললাম , “ তুই কি বলিস বল । আমি ফোন করব ?” ও বুকে যেন বল পেল, সঙ্গে সঙ্গে বলল , “হ্যাঁ তুইই কর । তুই আর স্নেহা ছাড়া আমার পাশে
দাঁড়ানোর মত কেউ নেই আর” ।
“ঠিক আছে, রাখ এখন তুই আমি এক্ষুনি করে দেখছি” , বলে রমেন মিত্রর নাম্বার
ডায়াল করলাম ।
শিরিণ যেরকম বলেছিল তাই শুনলাম, ভদ্রলোকের বেশ ভারী গলা, পুরুষালী । এই
গলার আওয়াজেই প্রথমে ধরাশায়ী হয়েছিল শিরিণ । হুম , বেশ আকর্ষণীয় বটে !
সরাসরি কথা শুরু করলাম, “ আমি শিরিণের
বান্ধবী লিপিকা, আমার কথা তো ওর কাছ থেকে শুনেছেন, আমিই ওর প্রোফাইল খুলে দিয়েছি বেঙ্গলি ম্যাট্রিমনিয়ালে, আপনার সঙ্গে একটু
কথা ছিল , বলব ?”
একটু সংশয় ছিল, ভদ্রলোকের মেয়ে সামনে আছে কিনা কে জানে , তাহলে তো আবার কথা
বলতে পারবেনা ! কিন্তু দেখি বলল, “ হ্যাঁ বলুন” ।
আমি শুরু করলাম, “দেখুন, আপনি তো শিরিণকে দেখেছেন, কথা বলেছেন, ওর বাড়ি
গেছেন,মাসির সঙ্গে আলাপ ও হয়েছে । মেজমাসির সঙ্গে আপনার ফোনে কথা হয়েছে, আপনি
বলেছিলেন আপনার মতামত দাদার সঙ্গে আলোচনা করে জানাবেন ।কিন্তু এখনও কিছু জানাননি”।
রমেন মিত্র বলল, “ আমি তো সেদিন
আপনার বান্ধবীকে বলেই এসেছিলাম আমি ফেব্রুয়ারীর আগে বিয়ে করতে পারবোনা । আমার
মেয়েকে অ্যানিমেশন কোর্সে ভর্তি করে
মুম্বাই পাঠিয়ে তারপর” ।
“কিন্তু আপনি তো পরিষ্কার করে কিছু বলেননি । আমরা কি তাহলে অপেক্ষা
করব ?
বুঝতেই পারছেন ম্যাট্রিমনিয়াল থেকে আরও কিছু সম্বন্ধ আসছে” , মরীয়া হয়ে বলি আমি ।
“হ্যাঁ হ্যাঁ , আমি তো বলেই এসেছি , আপনারা দেখুন , আমার জন্য ওয়েট করে
থাকবেন কেন ?”
“দেখুন আপনাকে খোলাখুলিই বলি , আপনি ওদের বাড়ি যাবার ৫ দিন পর হঠাৎ
ফোন করে শিরিণের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন, এতে আমাদের মনে হয়েছে যে আপনি এই সম্বন্ধটাকে
এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজী” ।
রমেন মিত্র একটু আমতা আমতা করতে লাগলো, “ না মানে আমি তো , আমি তো উনি কেমন
আছেন জিজ্ঞাসা করতে ফোন করেছিলাম , উনি কি বলছেন ?”
“
দেখুন, আমরা সেই ছোট বেলাকার থেকে বন্ধু , রোজই আমাদের কথা হয়, আমি জানি ওর এই
ব্যাপারে মত আছে, ও ওয়েট করতে রাজী”। বলেই ফেললাম ।
রমেন মিত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে গেল তারপর বলল, “ঠিক আছে , এই শনি
রবি আমার ছুটি আছে, দাদার ওখানে গিয়ে কথা বলে আপনাকে জানাবো” ।
“হ্যাঁ
প্লীজ জানাবেন কেননা যে কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিনা
শুধু আপনার মতের অপেক্ষায়” ।
“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই , এই নাম্বারটা সেভ করে রাখছি, উনাকে ফোন করাটা মনে হয় ঠিক হবেনা, পসিটিভ, নেগেটিভ যাই
হোক না কেন আপনাকে জানিয়ে দেবো” , খুব বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল রমেন মিত্র ।
আঁচ করলাম নেগেটিভ উত্তরই আসবে ।কথাবার্তার টোনে বোঝা গেল । বেচারী শিরিণ !
কিভাবে একটু আশার খড়কুটো বুকে আঁকড়ে ধরে অসীম সমুদ্রে সাঁতার কেটে চলেছে । সেটুকু
কি করে কেড়ে নিই !
অনেকক্ষণ
বসে চিন্তা করলাম , নাহ ! বলতে আমাকে হবেই নয়তো আরও আশার জালে জড়িয়ে পড়বে , সেখান
থেকে তাকে বের করা মুস্কিল হয়ে যাবে । ফোন টা করেই ফেললাম ।
( ক্রমশঃ)
0 comments:
Post a Comment