বিকেল তো রোজই আসে । কিন্তু নিঃসঙ্গ বিকেল ? আর সে যদি হয় বসন্তের বিকেল ? সবার অনুভূতিতেই তো এইরকম একটা বিকেলের স্মৃতি
মনের কোণায় পদচিহ্ন রেখে যায় ।
এই রকম বিকেল আমায় শুধু বিষণ্ণই করেনা একটা চাপা হাহাকার বুকের
ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে দেয় ।
সেই বসন্তের বিকেলে ফাগুনের হাওয়া ছিল , আসন্ন
দোলের রঙ্গিন প্রস্তুতি ছিল , আকাশের রঙ লাল ছিল কিন্তু সে রঙ রাঙা পলাশের ছিল না ।
আমি তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি । আমাদের বাড়ীর
উঠোন টা বেশ বড় হওয়াতে আশেপাশের সমবয়সী বন্ধুরা সব বিকেলে ওখানেই চলে আসতো আর আমরা
চু কিৎ কিৎ থেকে শুরু করে এলাটিং বেলাটিং সই লো
, ধাপ্পা
, লুকোচুরি, কানামাছি
ভোঁ ভোঁ সব খেলা ওখানেই খেলতাম ।
বাড়ীর কাছে ছিল কলেজ স্কোয়ার । শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে মেলা
হয়েছিল ওখানে , প্রত্যেক
বছরই হত । সেবার শিবরাত্রি শেষ হবার পর ও
মেলা ভাঙ্গেনি , আমাদের
প্রধান আকর্ষণ ছিল হাতে টানা চার বাক্সের নাগরদোলা । সুযোগ পেলেই চড়তে চলে যেতাম ।
সেদিন বিকেলে ও যথারীতি বন্ধুরা সব
এসে হাজির আমাদের সেই উঠোনে। কিন্তু খেলার বদলে নাগরদোলা চড়ার প্ল্যান হল । পরের দিনই মেলা ভেঙ্গে যাচ্ছে সুতরাং আজই মজা করার
শেষ দিন ।
কিন্তু আমার বাড়ি থেকে অনুমতি
পাওয়া গেলনা । বাকি সব বন্ধুরা হই হই করতে
করতে আমার চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি বাড়ীর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রক দিয়ে
চোখের জল মুছছি আর শূন্য দৃষ্টিতে রাস্তার লোকজন দেখছি ।
আমি ছাড়া বাকি সব্বাইকে সুখী
ভাবতে থাকছি কেননা আমি বন্ধুদের সঙ্গে নাগরদোলা চড়তে যেতে পারিনি ,আমায় যেতে দেয়নি
। আমার মত দুঃখী আর কেউ নেই ।
এরা সব কত স্বাধীন কত সুখী ! রাস্তার কলে জল নিতে আসা বৌটি ,
গামছা পরে কলের তলায় স্নান করতে বসা ছেলেটা , কয়লার দোকানে কেরোসিন তেল দিতে আসার
ট্যাংকারের লোকটা , ট্যাংকারের ওপর বসে থাকা কয়লাওয়ালার বাচ্চা ছেলেটা ,রিক্সা
নিয়ে অপেক্ষা করা রিকশাওয়ালা , মুদির দোকানে পেঁয়াজ কিনতে আসা পাশের গলির শীলাদি
মায় দোকানের সামনে কয়লার উনুনে উবু হয়ে বসে রুটি বানানো হিন্দুস্থানি মুদিওয়ালার বৃদ্ধা মা পর্যন্ত আমার
চেয়ে সুখী বলে মনে হচ্ছিল ।
বসন্তের সেই উজ্জ্বল বিকেলবেলাটা
শুধু আমাকেই বিষণ্ণতার কালো চাদরে ঢেকে দিয়ে অন্য সবার কাছে চলে গেছিল
।
সন্ধ্যে ৬টার শো এ পিসিরা সিনেমা যাবে বলে রেডি হচ্ছিল ।
ভেতর
থেকে আমায় ডাকল , মিঠু আয় তো কুঁচি টা ধরে দে !
মুখ ব্যাজার করে ঘরে ঢুকলাম । রাগ
দেখিয়ে ধপধপ করে মাটিতে পা ফেলে পিসির
সামনে এসে মেঝেতে বসে পড়লাম ।
কুঁচিতে হাত দিতে যাবো হঠাৎ দাআআম করে
একটা কানফাটানো আওয়াজ !
একেবারে
চমকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি জানালার সামনে
চকমকে হলুদ লাল আলো ! খুব জোরে
হেলছে দুলছে ! সঙ্গে একটা হা হা করা শব্দ !
কানের কাছে মা পিসি যখন চিৎকার করে
উঠল “আগুন ! আগুন !” তখন উপলব্ধি করতে পারলাম এটা আগুন ।
যে কেরোসিন তেলের ট্যাংকারটা পাশের কয়লার দোকানে
কেরোসিন তেল দিতে এসেছিল , যার ওপরে বসে কয়লাওয়ালার ছোট্ট ছেলেটাকে খেলা করতে
এক্ষুনি দেখে এসেছি সেই ট্যাংকারটা ফেটে গেছে । মুহূর্তের মধ্যে তেল ছড়িয়ে বিশাল আগুন পুরো এলাকাটাকে নিজের গ্রাসে নিয়ে
ফেলেছে ।
রাস্তার একেবারে পাশেই আমাদের ঘরের দুটো বড় জানালা । সেগুলো খোলাই ছিল । হতবাক হয়ে দেখছি কি ভয়ঙ্কর সে আগুনের আলো
! আগ্রাসী খিদে নিয়ে তার লেলিহান শিখা চলে আসতে চাইছে ঘরের ভেতরে ।
মা দৌড়ে গিয়ে খাটের পাশের জানালাটা
বাইরে হাত বাড়িয়ে টেনে বন্ধ করল । জানালার দু সেট পাল্লা ছিল । বাইরেরটা কাঠের আর ভেতরেরটা কাঁচের । মায়ের
হাতে ফোস্কা পড়ে গেল ।
মা পিসি হই হই করে সামনের ঘর থেকে বালিশ , বিছানা , চাদর শাড়ি জামা সব নিয়ে
পেছনের দিকের ঘরে নিয়ে ফেলছিল । আমি তখনো এক জায়গায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । কে একজন
বলল, কিরে জিনিসগুলো সরা !শো কেসের ওপর ছোট একটা রেডিও রাখা ছিল । আমি ওটা তুলে
নিয়ে দে দৌড় !
আমার
মা খুব সাহসী ছিল ,হাতে ফোস্কা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মেন গেট খুলে অন্যান্য কাকুদের
সঙ্গে ট্যাঙ্ক থেকে বালতি বালতি জল আগুনের দিকে ঢালছিল ।
আমাদের
কারো বুদ্ধি কাজ করছিল না । আমার এক পিসি তো ঘর থেকে বালিশ কম্বল সব নিয়ে এসে জলে
ভরা সেই উঠোনের ওপর ফেলে দিয়ে ওগুলোর ওপরেই বসে পড়ল ।
আর
এক পিসি আমাদের চার ভাইবোনকে পিছনের ঘরের এক বিশাল পালঙ্কের তলায় ঢুকিয়ে বসিয়ে
দিয়ে গেল, একদম এখান থেকে না বেরোনোর কড়া আদেশ দিয়ে ।
চারিদিকে হই হট্টগোল আর আমরা বিভ্রান্ত ,
আতঙ্কিত হয়ে চারজন চারজনকে জড়িয়ে ধরে বসে
আছি ।
কতক্ষন
ধরে সে অগ্নির তাণ্ডব চলল জানিনা । গর্ত থেকে বিড়ালের বাচ্ছা টেনে বের করার মত
আমাদেরও একসময় পালঙ্কের নীচ থেকে যখন টেনে
বের করা হল তখনও আমরা কাঁপছি ।
পরে
জানতে পেরেছি আমার ধারণায় যে সব সুখী
মানুষগুলো জীবন্ত হয়ে চলাফেরা করছিল ,
যাদের আমি ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এরা সবাই আমার থেকে বেশি সুখী ,তারা
সবাই সেই বিধ্বংসী আগুনের শিকার হয়েছে ।
দমকলের লোকেরা আগুন নেভাবার পর তাদের
পোড়া দোমড়ানো , মোচড়ানো , কালো শব দেখে
সবাই শিউড়ে উঠেছে ।
রাস্তার
কল থেকে জল নিতে আসা সেই বউ জল নিয়ে আর ঘরে ফেরেনি , “মেরে আঙ্গনে মে”
গান করতে থাকা ছেলেটার স্নান আর শেষ হয়নি, কয়লাওয়ালার ছোট্ট ছেলেটার নাম আর
স্কুলের খাতায় লেখা হয়নি, বিহারী সেই রিক্সাওয়ালাকে রাতেরবেলায় আর ছাতু মাখা খেতে
হয়নি আর মুদিওয়ালার সেই বৃদ্ধা মাকে আর কোনদিন রুটি সেঁকতে হয়নি ।
সেদিন রাতের আকাশ বাতাস গুমরে কেঁদে
মরছিল যখন কয়েকদিন পর মাধ্যমিক দেবার কথা ছিল যার সেই শিলাদির বিধবা মা মেয়ের পা থেকে খুলে যাওয়া এক পাটি চটি কে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলছিল , ওরে মা রে ! কেন
রে তোকে আমি মুদির দোকানে পাঠালাম ! তুই তো যেতে চাইছিলিনা ! তোকে কত কি শোনালাম ! তুই রাগ করে কিনতে এলি ! আমি এ
কি করলাম ! ফিরে আয় ফিরে আয় মা ! আমার যে আর কেউ নেই রে সোনা !
সেই
কান্না , সেই হাহাকার সেই এক লহমায় চারপাশ ওলট পালট হয়ে যাওয়া এখনও আমার স্নায়ু কে
নিপীড়ন করে ।
এখনও কোন বসন্তের বিকেলে একাকী থাকলে শিউড়ে উঠি । ত্বরিতে একবার
চারিপাশে চোখ বুলিয়ে নিই । আশেপাশে কোন সুখী মানুষ নেই তো ?